অজুতে নিজুতে ঢাকাবাসীরা যে প্রতিনিয়ত একে অন্যের ব্যক্তিগত বলয় আক্রান্ত করে তাঁর তাৎপর্য কি? আমার এক নরওয়েজিয়ান শিক্ষক বলেছিলেন বাংলাদেশের কেউ যদি বলে সে একা তাঁর খুব অদ্ভুত লাগে, সব জায়গাতেই এত মানুষ! ঢাকার মানুষের একাকীত্বের ধারনা বোধয় এরকম শরীরী না। একাকীত্বের চাইতে বিচ্ছিন্নতা কথাটা বেশি খাটে আমাদের জন্য। হয়তো এখানে একাকীত্ব যতটা মানসিক অবস্থা নির্ভর ততটা শরীরী বাস্তবতা না।
ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া নাকি এই নগরের তরুণদের বৈশিষ্ট। মানুষের ভাবপ্রবনতাকে সবসময় সমাজবিজ্ঞানীর মত কাটাছেঁড়া করতে যাওয়াটা অমানবিক মনে হয়। কারনা অধিকার আছে আবেগতাড়িত হবার? কারনা অধিকার আছে নিজেস্ব নির্জনতায় ডুব দিয়ে লীন হবার? নিজেকে বিশেষায়িত করার হক প্রত্যেকের নিজের আমি তাঁর যথার্থতা নির্ণয়ের কেউনা।
আমি কয়েক কোটি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা নাগরিক মধ্যবিত্তের একজন। চৈত্রের কড়া রোদে, ঘামে আঠালো দুপুর থেকে আমিও মুক্তি চাই। নিজের ভেতরের ভাবপ্রনতায় লীন হতে চাওয়া ছাড়া আমার আর উপায় নাই। আশে পাশে অনেক খণ্ড খণ্ড রুঢ় সত্য। তাঁদের বাস্তবতায় আক্রান্ত না হতে চাইলে নিজেস্ব ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি?
এই ভাবাবেগে ভেসে যেতে যেতে মনে হয় এই লক্ষ কোটি মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষির এই শহর কোনদিন কি আমার ছিল?! জন্মভূমি আর জন্মের শহরের সাথে মানুষের আসলে কিভাবে সম্পর্ক হয়? বর্তমানের বিশ্ব নাগরিকের মানস কাঠামোয় দাঁড়িয়ে আত্নপরিচয়ের মূল সন্ধানী মানুষেরা জন্মভূমি, জন্মের শহরকে কিভাবে দেখেন আমি জানিনা। আমি দেখি একটা নিছক সীমারেখা হিসেবেই, যার ভেতরে নিত্য ক্রিয়াশীল ঘটনার মধ্যদিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে মানুষ। সামাজিকীকরন, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস সবকিছু মিলে তৈরি হয় স্মৃতি। আমার কাছে এই স্মৃতিই আমার দেশ, আমার শহর।
যতবার দেশের বাইরে থেকে ফিরেছি মনে হয়েছে কোথায় যেন একধরনের শুন্যতা তৈরি হয়েছে। আমার নিত্যদিনের ঢাকা আর সেই ঢাকা নেই। বাস্তবতার উপলব্ধির সাথে সাথে আমার স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ না। আমি একটি বাস্তবতা মেনে নিয়েছি। ঢাকা তাঁর সমস্ত কদর্যতা আর নির্মমতা নিয়ে আমাকে আক্রান্ত করলে সচ্ছল মধ্যবিত্ত হিসেবে আমার পালাবার জায়গা আছে। হুমায়ূন আজাদ, সাগর-রুনি, বিশ্বজিত, রাজীব, অভিজিত আরও কত শত নাম না জানা গুম খুনের ঢাকায় আমি তাই আসলে বহিরাগত। এই শহরে আমার কোন সম্পৃক্ততাই আসলে আমার আত্মার যোগ না। তাই প্রতিবাদ সমাবেশে একাত্নতা প্রকাশ করি কেবল ছবি শেয়ার দিয়ে, সশরীরে উপস্থিত থাকেন সেই হাতে গোনা কয়েকজন চেনা মুখ। অভিজ্ঞতা থেকে জানি তারাও অবাক হন্না এতে।
বর্ণবাদ বিরোধী এক কৃষ্ণাঙ্গ নেতা ফ্রেডারিক ডাগলাসের আত্নজীবনী পড়েছিলাম। অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস ভূমিকায় বলেছিলেন “গরম কেৎলির বাষ্প বেরনোর পথ না থাকলে কেৎলি ফেটে যায়, তেমনি দাসত্ব প্রথার ভেতরের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের একটা নিয়মিত বিমক্ষোণ না ঘটলেও প্রথা ভেঙ্গে পড়তে পারে।” মধ্যবিত্তের বিমক্ষোণ মনে হয় এই ক্ষুদ্র প্রতিবাদগুলো আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তোলপাড় করায়। নইলে বোধয় গনপ্রজাতন্ত্রের এই আঁটসাঁট ব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়তো অচিরেই।
তবুও আমি বিশ্বাস করি আমরা বাধ্য অনুগত প্রজা থাকিনা সব সময়। শাহাবাগ যারা দেখেছে তারা মানবেন যে বাঙালী আত্নসন্মানে আঘাতের জবাব দেয়। রাজনীতির দৃশ্যমান মঞ্চে যে অভিনয় চলে তাঁর পেছনেই আসল ক্ষমতার খেলা। সেই খেলা জনগণের ক্রোধের অর্জনকে ছিনতাই করেছে বার বার। ৭১এও, শাহাবাগেও। আজো অভিজিতের হত্যা ব্যাবহারীত হচ্ছে নানান রাজনৈতিক চালে। কিন্তু তবুও আমরা আশা করি। প্যানডোরার সেই বাক্স উপহার দিয়েছে শাসক গোষ্ঠী। গুম, খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন সবই ছড়িয়ে পড়েছে, আমাদের আছে কেবল আশা। লক্ষ কোটির গা ঘেঁষাঘেঁষির শহরে আমরা সত্যি একা!
লক্ষ কোটির গা ঘেঁষাঘেঁষির শহরে আমরা সত্যি একা!,আমি ও আপনার সাথে সহমত পোষণ করছি