উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিষয়ে আমার একাডেমিক ট্রেনিং আছে। নিও লিবারাল অর্থনীতির যুগে সমাজ বিজ্ঞান সহ অন্যন্য সকল বিভাগের মত এই বিভাগটিও এনজিও মুখী পড়াশোনা দিয়ে খুব বেশি মাত্রায় প্রভাবিত ছিল। নিজের পড়ার আগ্রহের কারনে অথবা অন্য যে কারনেই হোক ততোদিনে আমার বিভাগ নিয়ে মোহভঙ্গ হয়েছে। বিভাগের বাইরে এসে যখন প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলে পাঠচক্র, আলোচনার সাথে পরিচিত হলাম তখন নারী বিষয়ে কতগুলো নতুন শব্দবন্ধের সাথে পরিচিত হয়েছি যা আমার একাডেমী আমাকে শেখায়নি। যেমন নারী ইস্যুতে আলোচনা করতে গেলে “নারী-পুরুষ সম্পর্ক” কথাটা প্রায়ই ব্যাবহার হতে শুনেছি।
প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগলেও এই টার্ম/শব্দবন্ধের কিছু সুবিধাজনক দিক আছে আবার কিছু অসুবিধার দিকও আছে। সুবিধা হোল এটা নারী পুরুষকে একসাথে সম্বোধন করে। কেবলমাত্র নারীকে নিয়ে অনেক বেশি আলো ফেলে পুরুষের করনীয়কে অদৃশ্য করে দেয়না যেটা বিভাগের পড়াশোনায় প্রায়ই দেখেছি। কেউ যেন এটা না বোঝে যে আমি মনে করছি নারী অবস্থা নিয়ে আলোচনা কম হওয়া উচিত। আমার বরং মনে হয় নারী ইস্যুতে যথেষ্ট গুরুত্ব ও প্রাধান্য নিয়ে আলোচনা হয়ইনা একরকম। আমার মতে “জেন্ডার” ধারনাটা আলোচনায় না এনেই “নারী-পুরুষ সম্পর্ক” কথাটা একই সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নারী পুরুষ সম্পর্কে উপযুক্ত আচরনবিধি কি হতে পারে সেই সম্ভাবনার দিকে আলো ফেলে। এই শব্দ বন্ধের সবচাইতে সফল দিক আমি মনে করি এটাই।
যখন এটা নারী জীবনের সমস্ত দিকের বা ইস্যুর প্রতিস্থাপক হয় তখন “নারী-পুরুষ সম্পর্ক” কথাটা শুনলে আমার গায়ে জ্বালা ধরে যায়। পুরুষের সাথে সম্পর্কের বাইরে নারী নাই নাকি?!! আজ যদি আমি সমকামী হই বা যদি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আদর্শের কারনে পুরুষের সাথে যৌন সংসর্গ থেকে শুরু করে সমস্ত সম্পর্ক বর্জন করি আমার কথা কি তাহলে এই টার্মটা বলতে পারবে?! আমি গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজে পড়েছি, আমি নিশ্চিত চাইলে এমন এমন প্রতিষ্ঠানে আমি সারাজীবন পার করতে পারি যেখানে কোন পুরুষ নাই। তাতে আমি কি বৃহত্তর যে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো আছে তাঁর নিপীড়নের বাইরে থাকবো? তাহলে পৃথকীকরণ ব্যবস্থায় থাকা নারীরা সবচাইতে নিপীড়ন মুক্ত থাকতো বলা যায়। আমি মনে করি এনজিও প্রকল্পের বাইরে সমকামিতা, যৌনতা ইত্যাদি বিষয়ে সর্বজনের আলোচনা খুব কম হয়েছে। সেটার সাথেই তাল মিলিয়ে নারীর জীবনের এই প্রশ্নগুলো আজো অনুচ্চারিত আছে।
কেবল নারীর সাথে সম্পর্কে থেকেও নারী ও আরো অনেকেই পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতনের শিকার হতে পারে। তাই যদি হয় তাহলে নারী জীবনের সমস্ত প্রশ্নকে “নারী-পুরুষ সম্পর্ক” টার্ম দিয়ে রিপ্লেস করা অর্থহীন। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতেও “নারী-পুরুষ সম্পর্ক” কথাটা কিছুটা অনুপযোগী। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর সম্মতিতেও বৈধ হয়। যে পুরুষ পাবলিক প্লেসে অচেনা (তাঁর সাথে সম্পর্কে না থাকা) নারীকে যৌন হয়রানী করে সে তাঁর বউয়ের কাছে আদর্শ পুরুষ হতে পারে। বউয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক মধুর হতে পারে। তাহলে তাঁর এই নারী বিদ্বেষী আচরন কি “নারী-পুরুষ সম্পর্ক” কথাটা ব্যাখ্যা করতে পারে?
ফুকোর একটা কথা আছে “Self is the sight of multiple practices” সহজ বাংলায় বলতে গেলে এটা বোঝায় মানুষ নিজে বহুবিধ চর্চার একটা ক্ষেত্র। এর সহজ একটা উদাহরন দেয়া যেতে পারে পুরুষের ক্ষেত্রে। যে পুরুষ পাবলিক প্লেসে যৌন হয়রানী করে, সেই পুরুষ হয়তো তাঁর কন্যা সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। তাঁর প্রতি অসন্মানের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও কিছু সুবিধা তাঁর স্ত্রী, কন্যাকে দিচ্ছে, এমনভাবে যাতে পুরুষ হিসেবে তাঁর প্রভু অবস্থার কোন সংকটে পড়ছেনা। “নারী পুরুষ সম্পর্ক” কথাটা ঐ পুরুষের পাবলিক প্লেসে হয়রানী করার কথাটা উল্লেখ করতে পারেনা। এই টার্ম ঐ পরুষের নিপীড়নকারী স্বভাবকে নতুনভাবে চিহ্নিত করার জন্য শুন্যতা তৈরি করে, সাথে সাথে সম্পর্কে থাকা নারীদের প্রতি নুন্যতম মানবিক আচরন চিহ্নিত করায় তাকে হয়তো আরও সচেতন করে তোলা যায় সেই পথ দেখায়।
কোন কিংবদন্তী দার্শনিক পুরুষের নারী বিষয়ক অবস্থান বুঝতেও টার্মটা যথেষ্ট না। এটা নারীবাদের, নারীর, পুরুষের জীবনের একটা অংশ হতে পারে মাত্র, একটা কিন্তু কম জরুরী না মোটেও। নারীর সাথে সম্পর্কে না থেকেও পুরুষের, নারীর বা যে কারো নারী সম্পর্কে ভাবনা থাকতে পারে। যেটাতে ধর্ম, সংস্কৃতি, বিদ্যমান সমাজের আদর্শ প্রতিফলিত হতে পারে। সেই যে কেউ পুরুষতান্ত্রিক কিনা তা বুঝতে এই টার্মটা আমার একেবারেই যথেষ্ট মনে হয়না। এটা খুবি জরুরী কিন্তু একটা দিকে আলো ফেলে মাত্র।
কোন প্রতিষ্ঠানের নারী-পুরুষের কোড অফ কন্ডাক্ট বা উপযুক্ত আচরণবিধি কেমন হবে সেই বিষয়ে বলতে এই টার্ম ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি বা তাঁর আদর্শ অবস্থান বোঝাতে “নারীপুরুষ সম্পর্ক” কথাটা যথেষ্ট না। কেউ নারী বান্ধব কিনা, নারী বিদ্বেষী কিনা তা এই টার্মটা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারেনা।
আর একটা শব্দ যেটা প্রায়ই আলোচনায় শুনি সেটা হোল “ব্যাটাগিরি”। অনুমান করি “ম্যাস্কুলিনিটি” শব্দের চলতি বাংলা এটা। শব্দটা আমার খুবি পছন্দের কারন এর সহজবোধ্যতা। আমি “ম্যাস্কুলিনিটি” বিষয়ক একটা গবেষণার অনুবাদের অংশ ছিলাম। তখন এই শব্দের বাংলা করেছিলাম “পৌরুষ”। ভদ্রলোকী বাংলা এটা কোন সন্দেহ নাই। এটার চাইতে বরং “ব্যাটাগিরি” শব্দটা মানুষের সাথে অনেক বেশি যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু এই শব্দের সমস্যা হোল এটা সহিংস, আগ্রাসী, মাতব্বর সুলভ কিছু পুরুষালী বৈশিষ্ট্য বোঝায়। তারমানে সহিংস, আগ্রাসী আলগা কিছু পুরুষালী বৈশিষ্ট্যের পুরুষের আদলটাই এটা সামনে আনে। নরম, কোমল, ব্যর্থ, অসফল পুরুষগুলোকে নয়।
আমার বিভাগের এক শিক্ষক একবার বলেছিলেন বিভাগ এক্টিভিজম জায়গা না। তাঁরা হয়তো মনে করেন এক্টিভিজমের জন্য এনজিও আছে! এযাবৎ পর্যন্ত মানব সভ্যতায় নারী অধিকার সহ যা কিছু অর্জন হয়েছে তাঁরা হয়তো মনে করেন সেটা এনজিওর দান! তাই এক্টিভিজম এনজিওর হাতে ছেড়ে দিয়ে বিভাগে জনবিচ্ছিন্ন, “বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চা” করতে করতে চান তাঁরা। নারীবাদতো আসলে “উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ” নামে দুনিয়াব্যাপী যত বিভাগ আছে তাঁদের আবিষ্কার! তাঁদের উচিত শব্দগুলো প্যাটেন্ট করে রাখা! একাডেমীক জ্ঞান আসলে কতটা জন বিচ্ছিন্ন হতে পারে তাঁর প্রমান এটা।
শব্দের জন্ম, টার্ম নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখে কিছু বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে হয়। নারী বান্ধব, নারীবাদী একটা শব্দের উচ্চারন, উল্লেখ আসলে একটা জরুরী বিষয়। শব্দ কেবল ভাষাকে নির্দেশ করেনা, এটা অভিজ্ঞতার বাহক। স্মৃতি তথা ইতিহাসের ধারক। পতিতা, সতী ইত্যাদি শব্দের পুরুষবাচক শব্দ না থাকা যেমন নির্দেশ করে নারী পরুষের পৃথিবীতে বাঁচে তেমনি যৌন হয়রানী, বিবাহ উত্তর ধর্ষণ নারীর নিপীড়নের অভিজ্ঞতাকে মূর্ত করে। এগুলো জনমনে, জ্ঞানের জগতে ইতিহাসসৃষ্ট সত্ত্বা হিসেবে নারীর অভিজ্ঞতাকে স্পষ্ট করে তোলে। তাই নারীর অথবা যে কারো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া শব্দ যেমন কোন প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি হতে পারেনা, তেমনি হতে পারেনা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এক্টিভিজম, আর জ্ঞানচর্চা পরস্পর বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা হতে পারেনা। নারীর নিপীড়নের বাস্তব অভিজ্ঞতায় যেমন একাডেমী/বিভাগের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ হতে হবে তেমনি বিভাগের জ্ঞানকে উৎসাহিত করতে হবে সমাজ পরিবর্তনের দরকারি কাজগুলো করতে। পারস্পারিক আদান প্রদান ছাড়া জ্ঞান জনবিচ্ছিন্ন, স্থবির একটা বিষয়ে পরিনত হতে বাধ্য।