বিশ্বব্যাপি প্রোপাগান্ডা চলছে নাগরিকদের বিরুদ্ধে। নইলে বাঙ্গালীর এই ইতিহাস বিচ্ছিন্নতার কারন কি? দুই দফায় উপনিবেশিত যে জাতি তার নাগরিক জীবনে দাসের মনোবৃত্তি পরিহার করার সংগ্রাম কই? ফ্রাঞ্জ ফানন তার বইতে দেখিয়েছেন আফ্রিকার নারীরা কিভাবে সাদা পুরুষকে জীবনসঙ্গী করাকে জীবনের চরম সার্থকতা মনে করতেন। যে কৃষ্ণাঙ্গী ফরাসী সাদাকে পান প্রেমিক হিসেবে তার জয়ের তীব্র আনন্দ ক্ষণস্থায়ী, উপনিবেশিত মনের যে জটিল দ্বন্দ, হীনমন্যতা তা থেকে সাদা সঙ্গী মুক্তি দিতে পারেনি তাঁদের। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে নীরবে যে বর্ণবাদ চলে তা ফাননের বর্ণিত আফ্রিকা থেকে খুব সামান্যই ভিন্ন। পরিবার নামের নিরাপদ আশ্রয়ে নারী একইসাথে যেমন বর্ণবাদী আচরনের শিকার তেমনি পূরুষের প্রতিনিধি হিসেবে নারী শিকারির ভূমিকাও গ্রহন করেন।
এই দাসের সমাজে আমি যে সাদা চামড়া নিয়ে জন্মেছিলাম তাকে যে সৌভাগ্য হিসেবেই দেখা হয় তা আমি আজ বুঝি। হয়তো চেহারা নিয়ে এ কারনেই খুব বেশি ভাবতে হয়নি। বিয়ের বাজারে ওঠার যোগ্য যখন হয়ে উঠলাম তখন আমাকে যত ধরনের পারিবারিক চাপের মুখে পড়তে হয়েছে তাতে আমি কল্পনাও করতে পারিনা কালো মেয়েদের কি মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে সেই বাচ্চাকাল থেকেই তাকে খবর জানানো হয় যে সে কালো, তাই তার ভালো বিয়ে হবেনা। সমগ্র পৃথিবীর যে অসাধারন সৃষ্টি মানুষ তারতো জীবনের একটাই লক্ষ বিয়ে করা আর বাচ্চা পয়দা করা! এই দুই কাজ করতে না পারলে নারী জীবন তো ব্যর্থ!
আমার এক খালামনির দুই মেয়ে। বড়জন কালো ছোটজন ফর্সা। আমার দূরসম্পর্কের এক নানা একদিন নিচু গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করেন তোর খালার ছোট মেয়েটাই বেশি মিষ্টি কি বলিস?! আমি বুঝলাম তিনি কি বোঝাতে চাইলেন, বল্লাম আমি চেহারা দিয়ে আমার বোনদের মধ্যে পার্থক্য করিনা। তিনি হেসে আমার খোঁচাটা হজম করলেন, বোধয় বুঝলেন আরো বেফাঁস কথা বল্লে মুখের উপর উত্তর দিতে আমার বাধবেনা।
আমার ইডেনে পড়া এক আত্নীয়া আছেন। একদিন তিনি আমাকে এক বন্ধুর সাথে একটা কফি শপে দেখেন। আমি আমার বন্ধুর সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেই। তিনি বাসায় ফিরলে আমাকে বলেন “তুমি এত সুন্দর একটা মেয়ে এমন কুৎসিত একটা ছেলের সাথে কিভাবে ঘোর?!খাবার বিল কি তুমি দিস?! ক্যামন ছেলেদের সাথে মেশ যারা একটা ভালো জায়গায় খাওয়াতেও পারেনা?!” আমার বন্ধুর গায়ের রঙ কালো এবং সে কোন চাকরী করতনা।
আমার খুব কাছের বান্ধবীর এক বড় বোন ছিল। নিলা আপু অনেক গুণী এবং আমাদের দুইজনেরি খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। আপু যখন বাসা থেকে বিয়ের চাপে কোণঠাসা তখন তিনি প্রস্তাব ভেস্তে দেয়ার জন্য এক বুদ্ধি বের করলেন। তিনি খুবি কৌশলে কোন পরিবার কত লোভী সেগুলো বের করতে উঠে পরে লাগলেন। কিছু সাধারন প্রশ্ন ছিল তাঁর। “আপনার গাড়ী লাগবেনা? কি গাড়ী ভালো লাগে আপনার? সব সময় ব্যাবহারে জন্য একটা প্রিমিও তো থাকাই উচিত কি বলেন?!” তাঁর এই ফাঁদে কিন্তু অনেকে ছেলে পরিবারই ধরা পড়েছে।
পরিবারে বিয়ের কথা শুরুই করা হয় একটা অশ্লীল প্রশ্ন দিয়ে। কেমন ছেলে তোমার পছন্দ? আমি বলতাম যে ছেলে নারীদের সন্মান করে, যে ছেলে আমি যে নারীবাদী সেটাকে সন্মানের চোখে দেখবে, গ্রহন করবে, যে ছেলে দশটা-পাঁচটা অফিস করবেনা আশে পাশে যা হচ্ছে তা নিয়ে তাঁর ভাবনা থাকবে, সচেতনতা থাকবে………এই পর্যন্ত বলার পর আমার মুরুব্বী শ্রেণীর আত্নিয়া বিরক্ত হয়ে আমাকে থামিয়ে দেন। সঠিক শব্দ দিয়ে প্রশ্নটা আবার করেন। “ছেলের কি চাকরী তোমার পছন্দ? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট, ব্যাংকার, সরকারী চাকরী নাকি ব্যাবসায়ী?” নতুন প্রশ্ন শুনে থ মেরে যেতাম। চাকরী দিয়ে মানুষকে কিভাবে বোঝা সম্ভব?! কি অশ্লীল প্রশ্ন এটা?! মানুষকে তাঁর চাকরীর সাথে প্রতিস্থাপন করা?! আমার কাছে তো প্রশ্নটা বীভৎস লাগে। পুরুষের কেমন লাগে যখন তাকে মানবিক বৈশিষ্ট্য না চাকরী দিয়ে মাপা হয়? কত টাকা বেতন পান, কোন জায়গায় চাকরী করেন সেটা তাঁদের সমস্ত যোগ্যতার পরিমাপক হয়? একদিক দিয়ে হয়তো ঠিকি আছে। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবী বলেছিল বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেরা নাকি একটাই বিষয় দেখেন। মেয়ে দেখতে কত সুন্দরী (নাকি চামড়া কত সাদা?) আর বাপের কত টাকা! এমন যদি সত্যি হয় তাহলে নারী কেন কড়ায় গণ্ডায় উশুল করবেনা? একদম সচেতন ভাবে ভেবে বলছি, এটা পুরুষেরই দোষ।
এই ধনতান্ত্রিক পৃথিবীতে টাকা আর স্ট্যাটাসই যেখানে ঈশ্বর সেখানে পুরুষ যে মোটা বেতন আর ভালো চাকরির অপর নাম হয়ে উঠবে তাতে আর অবাক হওয়ার কি আছে? আজকাল মনে হয় পুরুষের মান সন্মান বোধ আসলে বোধয় কম। কত জাতের তকমা তাঁদের গায়ে! ধর্ষক, নারী নিপীড়ক, স্ত্রী হত্যাকারী, যৌতুক লোভী আরও কত কি? এই তকমাগুলো মোছার জন্য আজকের দিনে কোন পুরুষের কি আন্তরিক চেষ্টা আছে? আশা করি অতীতের কিছু বিখ্যাত পুরুষের সমাজ সংস্কারের চর্বিত চর্বণ আমাকে শুনতে হবেনা।
ধনতান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে নারী যদি প্রত্যক্ষ নিপীড়িত হিসেবে কয়েক দফা বন্দী হয়, পুরুষও বন্দী নিপীড়ক হিসেবে। ওতি ধন, ওতি ক্ষমতার অগ্নিমান্দে পুরুষ আর মানুষ নাই, পুরুষ হয়ে উঠেছে। আজকের অত্যাচারী পুরুষের সংজ্ঞা তাই পুরুষকেই বদলাতে হবে, তাকে মানুষ হয়ে উঠতে হবে। তাকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে হবে তাঁরা নারী মুক্তির সংগ্রামে আছেন। প্রতিমুহূর্তে প্রমান দিতে হবে তাঁদের সদিচ্ছার।
বাবা-মা জানেন না কিন্তু বিয়ে নিয়ে আমার একটা দুরাশা আছে। উপহার সামগ্রীর নামে আমার বিয়েতে যে যৌতুক দেয়া হবে আমি সব বিক্রি করে দেব। যৌতুকের টাকা, আমার নিজের ভাগের সম্পত্তি দিয়ে আমি নির্যাতিত নারীদের জন্য একটা আশ্রয়কেন্দ্র বানাবো। রাস্তা ঘাটে যখন হয়রানীর শিকার হয়েছি গভীরভাবে আমার নির্যাতিত বোনেদের উপলব্ধি করেছি। মনে হয়েছে প্রায় সকল সুখে তৃপ্ত মধ্যবিত্ত নারী হয়েও যদি এত গভীরভাবে অরক্ষিত বোধ করি ভাবতেও পারিনা আমার অন্য বোনেরা কেমন আছেন। আমাকে যে বিয়ে করতে চাইবে আমার এই স্বপ্ন, এই উপলব্ধি সন্মানের সাথে গ্রহন করেই তাকে সামনে আগাতে হবে কারন আমাকে বিয়ে করে যৌতুকটা তিনি পাবেন না।
apu eirokom vabe amader protteker e vaba darkar. apnar ei lekhata pore notun vabe nijeke vabte shikhlam.